বিশেষ প্রতিনিধিঃ
চট্টগ্রাম নগরীর বাকলিয়ায় বিয়ের দাবীতে হিন্দু প্রেমিক সুজন দেবনাথ জয়ের বাসায় মুসলিম প্রেমিক কলি ইছামনির অবস্থান নেওয়ায় নির্মম নির্যাতনের অভিযোগ পাওয়া গেছে। মুসলিম প্রেমিকা কলি ইছামনি(২২) আনোয়ারা উপজেলার সত্তার হাটস্থ কামাল সওদাগর বাড়ির মৃত মোঃ শফিকের মেয়ে।অপরদিকে হিন্দু প্রেমিক সুজন দেবনাথ জয় হাটহাজারি থানার মির্জাপুরস্থ মিলন দেবনাথের ছেলে এবং মুরাদপুরস্থ জিএম আইটি ইনস্টিটিউটের কর্মকর্তা। অনুসন্ধানে জানা যায়,২০১৮ সালে হাটহাজারির মোঃ জাহেদ নামের এক ছেলের সাথে কলি ইছামনির বিয়ে হয়। কিন্তু বিয়ের পর থেকে যৌতুকের জন্য প্রতিনিয়ত নির্যাতন করত তার স্বামী। নির্যাতনের মাত্রা বেড়ে যাওয়ায় কলি তার স্বামীর সাথে বিবাহ বিচ্ছেদ ঘটান। এরপরে এতিম-অসহায় কলি জীবন-জীবীকার তাগিদে একটি চাকরীর সন্ধানে এদিক-সেদিক ছুটতে থাকেন। ২০১৯ সালের জানুয়ারীর দিকে বহদ্দারহাট মোড়ে খাম্বায় সাঁটানো পোস্টারে দেখতে পান মুরাদপুরস্থ জিএম আইটি ইনস্টিটিউটে আকর্ষণীয় বেতনে কিছু মহিলা স্টাফ নিয়োগ দেওয়া হবে। এই বিজ্ঞাপন দেখে কলি অনেক আশা নিয়ে একটি চাকরী পেতে মরিয়া হয়ে সুজনের আইটি সেন্টারে যান। সে সুজনকে তার চাকরীর প্রয়োজনীয়তার কথা ভেঙ্গে বলেন। তখন সুজন তাকে চাকরীর নিশ্চয়তার কথা জানান এবং ৭৫০০ টাকা বেতন ধার্য করেন। কলি আশায় বুক বেঁধে খুব আন্তরিকভাবে দায়িত্ব পালন করতে থাকেন। তখন সে তার একমাত্র বোনের কালামিয়া বাজারস্থ বাসায় থাকতো। চাকরীর ১০-১৫ দিন অতিবাহিত হওয়ার পর সুজন তার সাথে ব্যক্তিগত বিভিন্ন বিষয়ে কথা বলতো। এসময় সুজন নিজেকে মুসলিম হিসেবে পরিচয় দেন। চাকরীর ১মাস পার হওয়ার পর সুজন কলিকে ৭৫০০ টাকা বেতন দেন। পরের মাসের ৫ তারিখ পর্যন্ত দায়িত্ব পালনের পরে সুজন কলিকে প্রেমের প্রস্তাব দেন। কলি তাকে প্রশ্ন রেখে বলে সে ডিভোর্সি এই বিষয়টি সুজনের পরিবার মানবে কিনা? তখন সুজন জানায় পরিবারকে সে রাজি করাবে। আরো ৫দিন পরে অর্থাৎ ১০ তারিখ সুজন কলিকে জানায় তাকে আর চাকরীতে আসতে হবে না, আজকেই সে মাজার সাক্ষী রেখে বিয়ে করবে এবং আতুরারডিপু এলাকায় একটি বাসা নেওয়া হয়েছে সেখানে তারা থাকবে। এই কথা শুনে কলি খুব আনন্দিত হয়ে হতাশ জীবনে আশার আলো খুঁজে পায়। সে বিনা বাক্য ব্যয়ে সুজনের প্রস্তাবে রাজি হয়। সুজনের সাথে দাম্পত্য জীবনের শুরুতে শারীরিক সম্পর্কের পর যখন কলি বুঝতে পারে সে হিন্দু তখন তার মাথায় আকাশ ভেঙে পড়ে। সে এরকম প্রতারণার তীব্র প্রতিবাদ করে। কিন্তু সুজন জানায় কলির জন্য সে ধর্মান্তরিত হবে। ২০-২৫ দিন পরে সুজন বাসাটি ছেড়ে দেয় এবং কলিকে অফিসের সহকর্মী পরিচয় দিয়ে নিজের বায়োজিদ থানাধীন রৌফাবাদ এলাকার ভাড়া বাসায় নিয়ে আসে। সুজন কলিকে নিষেধ করে কলি যেন নিজের পরিচয় তার মায়ের কাছে না দেয়। কলি সুজনকে ধর্মান্তরিত হয়ে ইসলাম ধর্মের রীতিনীতি অনুযায়ী বিয়ে সম্পন্ন করতে চাপ প্রয়োগ করে। কিন্তু সুজন আজকাল করে সময় ক্ষেপণ করে এবং প্রতিনিয়ত কলির সাথে শারীরিক সম্পর্ক চালিয়ে যেতে থাকে। এভাবে দীর্ঘ ৩-৪ মাস অতিবাহিত হওয়ার পর কলি অন্তঃসত্ত্বা হয়ে পড়লে সুজন তাকে চট্টগ্রাম মেডিকেলে নিয়ে গর্ভ নষ্ট করে। কিছুদিন পর কলি সুজনের মাকে এবং ছোট ভাইকে আসল ঘটনা খুলে বললে সুজন বিয়ের কথা অস্বীকার করে তাকে প্রতারক আখ্যা দিয়ে বাসা থেকে বের বের করে দেয়। তখন কলি সুজনকে জানায় তার বিরুদ্ধে আদালতে যাবেন সে। সুজন পরিস্থিতি সামাল দিতে কলিকে বলে যে, ২মাসের মধ্যে সে ধর্মান্তরিত হয়ে ইসলাম ধর্মের রীতিনীতি অনুযায়ী বিয়ে সম্পন্ন করবে। আপাতত একটা বাসা নিয়ে তারা আগের মত থাকবে। সেখানে ১ মাস থাকার পরেও সুজন ধর্মান্তরিত না হওয়ায় কলি ক্ষোভ প্রকাশ করেন, শুরু হয় দাম্পত্য কলহ। সুজন কলিকে শারীরিক নির্যাতন করতে থাকে। নির্যাতন-নিপীড়ন সহ্য করতে না পেরে কলি বোনের বাসায় চলে যায়। সুজন আগের মতো আবারো ধর্মান্তরিত হওয়ার আশ্বাস দিয়ে বলে যে, কিছুদিন পর তাদের সম্পত্তি বন্টন হবে এরপরে সবকিছু ঠিক করবে। প্রতিমাসে ৩০০০ টাকা করে কলিকে প্রদান করবে সেটা নিয়ে যেন থাকা-খাওয়ার খরচ চালাতে পারে। এর মধ্যে সুজন বাসা পরিবর্তন করে। মাসখানেক পরে কলি খোঁজ নিয়ে আবারো সুজনের বাকলিয়া থানাধীন রসুলবাগ আ/এলাকার নতুন বাসায় গিয়ে বিয়ের দাবীতে চাপ প্রয়োগ করতে থাকে। সুজন আগের মত আশ্বাস দিয়ে পাঠিয়ে দেয়। কিন্তু সুচতুর সুজন ০৪/০৩/২০২১ইং তারিখে প্রতারক উল্লেখ করে কলির বিরুদ্ধে আদালতে একটি জিডি করে। যার নং- ৮৬/২০২১ (পাঁচলাইশ)। এরপরে ২১/০৪/২০২১ইং তারিখে সিএমপি কমিশনারের নিকটও তার বিরুদ্ধে প্রতারণার অভিযোগ প্রদান করেন। এরপরে গত ০৮/০৮/২০২১ তারিখ সুজন কলিকে গুরুত্বপূর্ণ কথা আছে বলে বাকলিয়া থানাধীন ফুলকলি কারখানার সামনে আসতে বলে। সুজন এসে তাকে একটি ডেকসি-পাতিলের বস্তা দিয়ে বলে নতুন বাসা নেওয়া হয়েছে সেখানে উঠবে আজকে। এসময় সুজন কলির সাথে থাকা ভ্যানিটি ব্যাগে কিছু টাকা দিচ্ছে বলে চেইন খুলে কিছু একটা ঢুকিয়ে দেয়। কলি সরল বিশ্বাসে সেটা আর চেক করে দেখেন নি। এরপর সুজন ৫মিনিট পর আসতেছে বলে সেখানে দাঁড়াতে বলে। অপেক্ষার ১০মিনিটের মধ্যে র্যাবের একটি বিশেষ টিম এসে কলির ব্যাগ থেকে ২০০পিস ইয়াবা উদ্ধার পূর্বক তাকে চান্দগাঁও কার্যালয়ে নিয়ে যায়। তখন কলি নিশ্চিত হলেন তাকে ফাঁসিয়েছে সুজন। তার মাথায় আকাশ ভেঙ্গে পড়ে। কলি র্যাবের কাছে বিষয়টি খুলে বললে র্যাব তাকে ছেড়ে দেয় এবং সুজনের বিরুদ্ধে ধর্ষণের অভিযোগে মামলা করার পরামর্শ দেন। কলি সুজনের বিরুদ্ধে এখনো কোন আইনগত ব্যবস্থা না নিয়ে পূর্বের মত বারবার বিয়ের জন্য অনুরোধ করে যাচ্ছেন। আশ্রয়হীন কলি মাইজভান্ডারে এবং অন্যান্য মাজারে থাকে। কলি এখনো স্বপ্ন দেখেন সুজনের সাথে সুখের সংসারের। সর্বশেষ গত ২৬/১১/২০২১ইং তারিখে কলি আবারো বিয়ের দাবী নিয়ে সুজনের বাসায় গিয়ে অবস্থান নেন। সে ৪-৫ দিন অবস্থান নেওয়ার পর তাকে অমানবিক নির্যাতন শুরু করে সুজন এবং তার মা। তাদের অত্যাচারে কলির ঠোঁটের নীচে, হাতে এবং কোমরে মারাত্মক জখম হয়। সেখানে কলিকে একটি রুমে ঢুকিয়ে তালাবদ্ধ করে অনাহারে রাখা হয়। ৭দিন পরে পুলিশের সহায়তায় সেখান থেকে প্রাণে বেঁচে বের হয়ে আসে কলি। এই ব্যাপারে কলি আক্তার বলেন, এত নির্মম নির্যাতন এবং প্রতারণার পরেও সুজনের প্রতি আমার মনে অনেক বেশী ভালোবাসা সৃষ্টি হয়েছে। ইচ্ছা করলে আমি তার বিরুদ্ধে ধর্ষণ এবং প্রতারণার অভিযোগে মামলা করতে পারি। কিন্তু আমি সেটা করিনি, কারণ আমার ভালোবাসার মানুষটি আমার করা মামলায় জেল খাটবে সেটা ভাবতেও খুব কষ্ট লাগে। আমার প্রথম সংসারটি ভেঙ্গে গেছে, আমি চাই না এই সংসারটিও ভেঙ্গে যাক। আরো চেষ্টার পরেও সর্বশেষ সুজন তাকে স্ত্রী হিসেবে মেনে না নিলে কি করবে এমন প্রশ্নের জবাবে কলি বলেন, আমি আর কিছুদিন অপেক্ষার পরে অবশ্যই তার বিরুদ্ধে আদালতে যাব। তার শাস্তি নিশ্চিত করে প্রয়োজনে নিজেও আত্মহত্যা করবো। অন্যদিকে অভিযোগের বিষয়টি সম্পূর্ণ ভিত্তিহীন দাবী করে সুজন বলেন, আমি মেয়েটিকে চাকরী দিয়েছি, নিজের বাসায় আশ্রয় দিয়েছি সেটাই আমার জন্য কাল হলো। তার সাথে আমার কোন ধরণের শারীরিক সম্পর্কের প্রশ্নই আসে না। তার কারণে আমার জীবনটা বিষন্ন হয়ে গেছে। এই প্রতারক কলির মিথ্যাচারের কারণে আমাকে আমার পরিবার, সমাজ এবং সহকর্মীদের নিকট সবসময় মাথানিচু করে থাকতে হয়। তার বিরুদ্ধে আমি আদালতে সাধারণ ডায়েরী করেছি, পরবর্তীতে সিএমপি কমিশনারের নিকট অভিযোগ দায়ের করেছি। কমিশনার মহোদয় অভিযোগটির সত্যতা যাচাইয়ের জন্য বাকলিয়া থানায় প্রেরণ করলে অভিযোগের সত্যতা পাওয়া গেছে মর্মে প্রতিবেদন প্রদান করেন পুলিশ। এই প্রতিবেদনের ভিত্তিতে আমি আদালতে মামলা দায়ের করি। আদালত মামলার তদন্তভার সিআইডিকে প্রদান করেন। আমি চাই এই প্রতারকের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি হউক। কলিকে আটকের ব্যাপারে জানতে চাইলে র্যাব কর্মকর্তা আফতাব বলেন, একজন সাংবাদিক ফোন করে তথ্য প্রদান করেন যে, ইয়াবা ব্যবসায়ী কলি ইয়াবা সাপ্লাই দিতে বাকলিয়ার ফুলকলি এলাকায় অবস্থান করতেছে। এই তথ্য পেয়ে আমরা অভিযান পরিচালনা করি। তাকে এনে জিজ্ঞাসাবাদ করার পর যখন বুঝতে পারি সে অনেকটা মানসিক ভারসাম্যহীন এবং তাকে ফাঁসানো হয়েছে তখন আমরা তাকে ছেড়ে দিই। কলিকে বলেছিলাম ঐ ছেলের বিরুদ্ধে ধর্ষণের অভিযোগে মামলা দায়ের করতে।